কেন আত্মহত্যা করেছিলেন আদম পরিবারের ৯ সদস্য!
বাড়ির উঠানে খুড়ে রাখা কবর |
কেন আত্মহত্যা করেছিলেন আদম পরিবারের ৯ সদস্য!
২০০৭ সালের ১১ জুলাই। জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত জিএম এক্সপ্রেস ২৫৪ ডাউন নামক লোকাল ট্রেনটি নিয়মিত চলাচল করে। সেদিন ট্রেন চালাচ্ছিলেন লোকো মাস্টার অর্থাৎ ট্রেনের ড্রাইভার আব্দুল মতিন এবং মো. এনায়েত খান।
তখন ঘড়িতে সময় বেলা ৩টা বেজে ১০ মিনিট। জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি যখন ময়মনসিংহ পৌরসভার কাশর এলাকার ইটখলায় আসে, তখন হঠাৎ ড্রাইভাররা দেখতে পান, রেললাইনের বাঁ পাশ দিকে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ একে অন্যকে ধরাধরি করে অদ্ভুতভাবে রেল লাইনের দিকে আসছে। তারা শিশু, নারী ও পুরুষ মিলিয়ে সংখ্যায় মোট ৯জন ছিলেন। একই পরিবারের সদস্য তারা।
এমন দৃশ্য দেখে প্রথমে চালকরা কিছুই বুঝতে পারেননি। একটু বাদেই খেয়াল করলেন এই মানুষগুলো রেললাইন পার হচ্ছে না, বরং তারা লাইনের উপর চুপচাপ বনে পড়লো। চালকরা আতঙ্কিত হয়ে জোরে হুইসেল দিচ্ছেন, কিন্তু সেই নয়জন লাইনের উপরেই বসে আছেন। একটুও ভয় নেই তাদের চোখে মুখে। খুবই অদ্ভুতভাবে বসে ছিলেন তারা।
চালকদের আর বুঝতে বাকি নেই যে, তারা আত্মহত্যা করতেই রেল লাইনের উপরে এসে বসেছে। উপায়ন্তর না দেখে জরুরী ব্রেক টানলেন চালক আব্দুল মতিন এবং মো. এনায়েত খান। কিন্তু ট্রেন থামাতে ব্রেক করতে হয় অনেক আগে থেকে। ঐ ৯জন থেকে ট্রেন অতোটা দুরত্বে ছিলো না। তাই চালকদের চোখের সামনেই জলজ্যান্ত নয়জন মানুষকে চাপা দিয়ে অনেকটা দুরে গিয়ে থামলো ট্রেনটি।
ঘটনাস্থল |
সবাই ট্রেন থেকে নেমে দেখতে পায়, একটা বাচ্চা ছেলে এবং একজন তরুণী অর্থাৎ ২ জন তখনও বেঁচে আছে। এরমধ্যে তরুণীটি তার ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছে। স্থানীয় লোকজন পানি খাইয়ে তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়না। পথেই মারা যায় দুজন।
রেল লাইনের অনেকটা জায়গা জুড়ে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটা টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। রক্ত, মাংস আর হাড়ে পুরো রেললাইন ছিলো রক্তাক্ত। এমন দৃশ্য দেখে চালকদের একজন ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে দ্রুতই পৌঁছায় পুলিশ। আশেপাশের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায় নিহতদের নাম ঠিকানা। জানা যায় মা, ২ ছেলে, ৪ মেয়ে এবং ২ নাতি নাতনী একসাথে আত্মহত্যা করতেই এসেছিলো। তাদের বাড়ি রেললাইনের খুব কাছেই।
নিহতদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায়, সেখানে কেউ নেই। পাঁচ-ছয়টি কক্ষ বিশিষ্ট একটি মাত্র পাকা ঘর। বাড়ির সামনের উঠানে কবরের মতো বড় একটি গর্ত খোঁড়া। বারান্দায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে লাশ নেয়ার খাট। রান্নাঘরে পড়ে আছে কাটা ছোট মাছ। কেটেকুটে রাখা হয়েছে তরিতরকারিও।
পুরো বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বেশ কিছু ডায়েরি ও হাতে লেখা কাগজপত্র উদ্ধার করে। এগুলোর কিছু ইংরেজিতে আবার কিছু বাংলায় লেখা। এতে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য লেখা ছিলো। একটি ডায়েরিতে ইংরেজিতে লেখা ছিলো - “আমরা পৃথিবীর একমাত্র স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল পরিবার। মোহাম্মদের আইনের বাইরে এবং সব ধর্মের সব কার্যকলাপের বাইরে। তাহলে আমরা কারা? আমরা হলাম আদম।” এছাড়া আরেকটি পাতায় লেখা ছিলো - “সবার উপরে আদম সত্য, জুলুমের বিচারের ব্যবস্থা করিব” এমন ধরনের অসংখ্য মন্তব্য ছিলো সেখানে।
ময়মনসিংহ পৌরসভার তৎকালিন স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার মোজাম্মেল হক ইউসুফের সাথে কথা হয় হাঙ্গামা ২৪-এর অনুসন্ধানী টিমের। তখন কমিশনার জানান, ‘এ পরিবারের সঙ্গে এলাকার কারো কোনো সম্পর্ক ছিল না। কেউ তাদের বাসায় যেত না তারাও কারো বাসায় যেতেন না। এমনকি তাদের সঙ্গে কারো খারাপ সম্পর্ক বা রেষারেষিও ছিল না।’
এই বাড়ি থেকে বেড়িয়েই তারা মারা যান |
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে। আনোয়ার দরবেশ নামের এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা করা ‘আদম ধর্ম’। আনোয়ার ছিলেন এই পরিবারের প্রধান কর্তা। তার ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আব্দুল হান্নান থাকেন ময়মনসিংহের গোহাইলখালিতে। তিনি বলেন, “আমার ভাই (আনোয়ার দরবেশ) হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর পরে তার পুরো পরিবারের সবাই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। তারপর থেকে তারা আমাদের এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে দূরত্ব তৈরি করে। কেউ যদি ওদের খোঁজখবর নিতেও যেতো তাহলে তারা দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিত। এতে আর কেউ তাদের খোঁজ খবর নিতে চাইতো না।”
কিন্তু ওই বাসায় যেসব ডায়েরি এবং অন্যান্য বই পুস্তক, চিরকুট পাওয়া গেছে সেখানে খ্রিস্টধর্মের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহ এলাকার সবগুলো চার্চেই খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পরিবারের কেউই কখনোই কোনো খ্রিস্টধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি।
রহস্যজনক সেই ‘আদম বাড়ি’র নামফলকে লেখা ছিলো সতর্কবার্তা। এ ঘটনায় এর পর আরো বেশ কিছু নতুন টুইস্ট যুক্ত হয়। সেগুলো আমাদের পরবর্তী পর্বে উপস্থাপন করা হবে। যদি আপনারা আগ্রহী হন, তবে আমাদের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত প্রকাশ করুন।
এ ঘটনা কোনো উপন্যাস কিন্তু বিদেশি সিনেমার নয়। এটা বাংলাদেশের বাস্তব গল্প। যা নিয়ে ভিকি যায়েদ হাতে নিয়েছেন নতুন প্রজেক্ট। বিচিত্র ধর্ম বিশ্বাসের কারণে একই পরিবারের নয় সদস্যের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়েই হবে ভিকির নতুন কাজ। তবে এটা ওয়েব সিরিজ নাকি সিনেমা এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি এই পরিচালক। তিনি জানিয়েছেন শিগগিরই শুটিং শুরু করতে যাচ্ছেন ‘আদম পরিবার’র গল্প নিয়ে।
হাঙ্গামা২৪.কম